শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আহমেদ মাওলার ময়নামতী উপাখ্যান কুমিল্লার আয়না

আজকের কুমিল্লা ডট কম :
জুলাই ২১, ২০১৮
news-image

 

ইমরান মাহফুজ ঃ

ইতিহাসের বুকে হেঁটে হেঁটে কথা বলা খুব কঠিন। সবাই পারে না। ইতিহাসের শরীর বড়ই নির্মম। যেকোনো সময়ে হিতে বিপরীত হতে পারার ভয়ে। তবে যারা পারে তাঁরা আমাদের নমস্য।
তেমনি একজন সাহসি সৃজন ভাবুক আহমেদ মাওলা (সকারী অধ্যাপক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়)
মননশীল প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে তার পরিচিতির কথা সবাই জানলেও তার কথাসাহিত্যিক পরিচিতি অনেকটা দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে গেছে। তার লেখা উপন্যাস ‘অতগুন ঝরা ফাগুন দিনে’(২০১৫) কতিপয় মুখ’ মানুষ’(২০১৭) এবং ‘ময়নামতী উপাখ্যান’(২০১৮) ইতোমধ্যে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ‘ময়নামতী উপাখ্যান’ কুমিল্লার আয়না। একাদশ শতাব্দীর সমতটের রানী ময়নামতী ছিলেন চন্দ্রবংশীয় রাজা মানিকচন্দ্রের স্ত্রী। তিনি নাথধর্ম অনুসারি একজন সাধক। আপন সাধনায় তিনি ‘মহাজ্ঞান’ লাভ করেছিলেন। অগ্নি, জল, বায়ু তিন বস্তকে জয় করে ময়নামতী অমরতা লাভ করেছিলেন।

রাজা মানিকচন্দ্রের মৃত্যুর পর পুত্র গোপীচন্দ্রের সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। উপন্যাসের কাহিনি থেকে জানা যায়, রানী ময়নামতী ধ্যানযোগে জানেন, আঠারো বছর বয়সে গোপীচন্দ্র যদি বারো বছরের সৈন্ন্যাস ব্রত পালন না করেন ,তবে তার মৃত্যু অবধারিত। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত গোপীচন্দ্র ঘরে তন্বী–তরুণী স্ত্রী অধুনা–পদুনা রেখে, রাজত্ব ফেলে সৈন্ন্যাসি হতে চায়না। মন্দ লোকেরা বলতে শুরু করে, ময়নামতী চক্রান্ত করে পুত্রকে দূরে পাঠিয়ে নিজেই রাজ্য ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। শুরু হয় পুত্র–মাতার দ্বন্দ্ব, রাজবধূদের চক্রান্ত। শেষ পর্যন্ত ময়নামতী তার মহাজ্ঞানের বলে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং গোপীচন্দ্র হাঁড়িসিদ্ধাকে গুরু মেনে বারো বছরের সৈন্ন্যাস জীবন কাটিয়ে ফিরে আসে এবং ময়নামতী পুত্রে হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে পাহাড়ের গুহায় মহাজ্ঞানের শক্তি বলে অদৃশ্য হয়ে যায়। চরিত্র চিত্রণ, কাহিনি বিন্যাসে আহমেদ মাওলা যথেষ্ট শিল্পকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। উপন্যাসের কাহিনিতে এক ইতিহাস সম্মোহিত এক যুবকের সঙ্গে নাটকীয়ভাবে সাক্ষাৎ হবে পাঠকের, সে যুবক পাঠককে হাত ধরে নিয়ে যাবে সেই লুপ্তনগরিতে, একসময় যা ছিল অথচ এখন নেই। সেই প্রাচীন নগরিতে রোমাঞ্চকর এক মানস–ভ্রমণের স্বাদ পাবেন পাঠক।

উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায়ের সূচনায় ছয় পংক্তির অন্তমিলের একটা পদ্য আছে, প্রাচীন পুঁথির আবহ তৈরিতে এ পদ্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। প্রথাগত উপন্যাসের কাহিনি বিন্যাস থেকে ‘ময়নামতী উপাখ্যানের’ এই আঙ্গিক বিন্যাস ব্যতিক্রম। এটা করতে পেরেছেন কবিতা নিয়ে তাঁর অনেক দিনের কাজের কারনে।

সরল সমীক্ষায় বলা যায় বাংলার ইতিহাসে এই অঞ্চলের আদি -উপন্যাসে সরল বর্ণনায় সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে।লেখক ইতিহাসের বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও চরিত্রগুলোকে এমন অবিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, কোথাও রূপক-প্রতীক-ইঙ্গিতের আশ্রয় নেননি। কোথাও কোথাও নিলেও দারুণ লেগেছে। এতে উপন্যাসের আঙ্গিকে তিনি পাঠকের কাছে ইতিহাস তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটিতে আমরা মাঝে মাঝে কবিতার মত বর্ণনা, কোথাও গল্পের মত সরল । গন্ধ পাওয়া যাবে হিমু, মিসির আলীর স্রষ্টা, হুমায়ূন আহমেদের। তবে এই উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে মনে পড়েছে বিশেষ করে কথাশিল্পী আবুল কাশেম ও স্বকৃত নোমানকে, এই দুজন খুব দারুণভাবে ঐতিহাসিক সমতট কুমিল্লা নিয়ে নির্মাণ করেছেন কথাশিল্পের দেয়াল। তবে উপন্যাস, কেবল কাহিনি সর্বস্ব শিল্পমাধ্যম নয়,একই সঙ্গে তা জীবন ও জগতের অধিবাস্তবতার শিল্পকলা, এটা বোঝা যায় ।ময়নামতী উপাখ্যানের পাঠক প্রিয়তার প্রত্যাশায় ।

[ময়নামতী উপাখ্যান/ আহমেদ মাওলা, পরিবার পাবলিকেশন, প্রকাশ: ২০১৮, প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ, মূল্য: একশত পঞ্চাশ।]

আর পড়তে পারেন